A Xaverian in the City of Joy

আজ অনেকদিন পর আমার কিছু কলেজের বন্ধুরা রি ইউনিয়ন করবে বলে মেসেজ পাঠিয়েছে। সেটা পড়েই ,মনে পড়ে গেল সব অতীত স্মৃতি।

কথায় বলে  “In School you are given the lesson, then test/ but in life you are given the test, then the lesson”…..উক্তিটির যথার্থতা বুঝেছিলাম যখন স্কুলের গণ্ডি ছেড়ে ইউনিভার্সিটি তে গেছিলাম।আজ সেই গল্পই আপনাদের বলব।

Princep Ghat.. the many places were memories were created

কলকাতার পথে

 

সাল ১৯৯৭,উচ্চ মাধ্যমিকে স্টেটের মধ্যে খুব ভাল রেজাল্ট করেছি। বাড়ির সব্বাই ভীষণ খুশী।ছেলেবেলায় রাকেশ শর্মার আকাশ-অভিযানে আমিও যে স্বপ্নে বিভোর ছিলাম এতদিন, আজ তা বাস্তবায়িত করার যেন সঠিক সময় এসেছে।ঠিক হল কলকাতার কলেজে পড়াশোনা করব।ভাল রেজাল্টের দরুন কলকাতার ‘প্রেসিডেন্সি, সেন্ট জেভিয়ার,বা যাদবপুরের’ মত কলেজগুলিতে সুযোগ পেতে অসুবিধা হয়নি।বিষয় নির্বাচনের দিক থেকে কোনও দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিলনা।পদার্থ বিদ্যা নিয়েই পড়বো কারণ এর‘যুক্তি ব্যাখ্যা পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ আমার বেশ ভাল লাগত।আর নাসার গবেষক হবার একটা সম্ভাবনাও ছিল ।কিন্তু সমস্যা শুরু হল কলেজ নির্বাচন নিয়ে।বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন।কেউ বলেন প্রেসিডেন্সি তো কেউ যাদবপুর।কিন্তু আমার মনে কোথাও একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিল-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, জ্যোতি বসু-এনাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আমিও সদস্য হব একদিন।তাই নানান বিচার বিবেচনার পর স্থির করলাম সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজেই পড়বো।

 

আঠেরো বছর বয়সে ,বাড়ি থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।আমার অতি প্রিয় স্কুল-বন্ধু-শিক্ষকদের ছেড়ে আসার দুঃখ; নতুন জায়গা,নতুন মানুষ,নতুন পরিবেশ,নতুন বন্ধু পাওয়ার  রোমাঞ্চ; পুরুলিয়া রাম কৃষ্ণ মিশনের চরম রক্ষণশীল পরিবেশ থেকে কলকাতার অবাধ-উদ্দাম স্বাধীনতার স্বাদ পাবার আকাঙ্ক্ষা; মফস্বলের  তারকের শহরের ভিড় এবং চাকচিক্যে হারিয়ে যাবার ভয়- এসব মিলিয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করেছিল; যা সঠিক শব্দ দিয়ে লিখে বা বলে আপনাদের বোঝাতে পারবো না আজ। শুরু হলো জীবনের নাতিদীর্ঘ তিন বছরের আরো একটি নতুন অধ্যায়।স্কুল জীবনের মত দীর্ঘ না হলেও এই তিনটে বছরের অভিজ্ঞতা আমার জীবনের লক্ষ্যকে বদলে দিয়েছিল  আমূল। আর যে জন্য আমি আমার এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অধ্যাপকদের কাছে  আজও ঋণী।

কলেজের দিনগুলি

The City of joy কলকাতার বুকে কর্মচঞ্চল জাঁকজমকপূর্ণ একটি উদ্দাম  বোহেমিয়ান জায়গা হল পার্ক স্ট্রিট ।চারিদিকে ঝাঁ চকচকে দোকানপাট ,নাইট ক্লাব,বিলাসবহুল রেস্তরাঁ; আর তারই মাঝে ছিল আমাদের দেড়শ বছরের পুরনো The second oldest Jesuit Institution in India- St Xavier College । আসানসোলের বাড়ি থেকে প্রতিদিন কলেজ যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই আবারও গন্তব্য ইউনিভার্সিটির হোস্টেল। যদিও এই  হোস্টেল জীবন আমার কাছে নতুন নয়। তবুও কলেজের হস্টেলে এসে দেখলাম  খ্রিষ্টান আমলে তৈরি উঁচু ছাদ ,বড় জানালা বিশিষ্ট আলাদা আলাদা রুম বরাদ্দ প্রত্যেকের জন্যে। এক সাথে  নানা বয়সের,নানা জাতি-ধর্মের সব ছাত্ররা থাকে এখানে। রামকৃষ্ণ মিশনের হোস্টেল জীবনের তুলনায় কলেজের হোস্টেল জীবন আমার কাছে বেশ বিলাস বহুল মনে হয়েছিল।রামকৃষ্ণ মিশন হস্টেলে মেঝেতে আসন পেতে সব্বাই মিলে খেতে বসতাম একসাথে।আর কলেজের হোস্টেল ক্যান্টিনে টেবিলে বসে কাঁটা চামচ -ছুরি দিয়ে খাবার স্টাইল শিখলাম। আরও দেখতাম খ্রিষ্টান ছাত্রদের জন্যে ‘ইস্পেসাল গো-মাংসের’ও ব্যবস্থা ছিল।

 সঙ্গীত প্রেমীদের জন্যে ছিল মিউজিক রুম।অনেকেই গিটার বাজিয়ে বেশ সুন্দর গান গাইত। ছোটবেলার গিটার শেখার ইচ্ছেটা আবার জেগে উঠেছিল কলেজে এসে।উইক এন্ডে মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে মিলে ডিস্ক ড্যান্স ও করেছি এই রুমে।

এখানে এসে দেখলাম, দলগত ভাবে কাজ করতে হতনা মিশনের মতো। শুধু নিজের কাজগুলি নিজে করলেই হত।সব দেখে শুনে মনে হল যেন- ‘আমি বড়ো হয়ে গেছি’।

 

এতদিন কেবলমাত্র ছেলেদের সাথেই পড়ে এসেছিলাম।এখানে এসে দেখলাম, ছেলে মেয়ে বলে আলাদা কোনও ব্যবস্থা নেই;সকলে মিলে একসাথে পড়াশুনা করতে পারে।সুন্দর স্মার্ট পরিপাটি সহপাঠিনীর দেখে প্রথমে লজ্জা পেলেও,স্বভাবসিদ্ধ ভাবে খুব তাড়াতাড়ি এসব কাটিয়ে উঠেছিলাম এবং এই কো এডুকেশন সিস্টেমটা বেশ ভালই মনে হয়েছিল।

Bengali girl, the epitome of beauty with brains. Liberal, articulative, artistic, romantic, rebellious and overall loving nature…

কলকাতার অলিগলি

সারাদিন কলেজের গোছানো ক্লাসরুম আর ক্যাম্পাসে পড়াশুনা, লাইব্রেরী-গ্রুপ স্টাডি, পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত নানান প্রোজেক্ট, ল্যাবরেটরির নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা এসবের পাশাপাশি চলতো কলকাতা নগরী কে আমার চোখ দিয়ে ধীরে ধীরে নিত্য নতুন ভাবে আবিষ্কার করা।কখনও বিভিন্ন বইয়ের খোঁজ করতে একলায় পাড়ি দিতাম কলেজ-স্ট্রিট;   কখনও বা বন্ধুদের সাথে,ট্রাম-মেট্রো রেল- চক্ররেল- বা গঙ্গা বক্ষে নৌকা বিহারে যেতাম।আবার কখনো ‘প্রেমের প্রস্তাব দেব কি দেবনা’ এমন বান্ধবীদের সাথে গড়ের মাঠ – ভিক্টোরিয়া-কফি হাউসে আড্ডা জমাতাম। কখনো বা সদলবলে নন্দন -শিশির মঞ্চে সিনেমা থিয়েটার দেখতে যেতাম। সব মিলিয়ে দারুণ রোমাঞ্চকর এক জীবন।  

 

“হিন্দু মিশনারি ছেড়ে খ্রিষ্টান মিশনারি আদব কায়দা ,শহুরে ফ্যাশন, এনভায়রনমেন্ট, লোকজন,কেতাদুরস্ত পোশাক-আশাক ,খানা-পিনা এসবে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিচ্ছি নিজেকে। ‘কলকাতা তিলোত্তমা’ দিনে যত আকর্ষক রাতে ততই মায়াবী।যতই দেখি ততই অবাক হই।যায় হোক অসম্ভব সুপারসনিক গতিতে জীবন দ্রুত এগিয়ে চলছিল। বলতে আপত্তি নেই, জীবনের এই সময়েই মনে  এসেছিল প্রথম প্রেমের জোয়ার। রক্ষণশীল বাড়ির ছেলে হিসেবে উদ্দাম প্রেম আর হয়ে ওঠেনি অবশ্য তখন।যদিও আমি তার জন্য অনুতপ্ত নই তবুও একটা ‘বোকা বোকা সুন্দর স্মৃতি’ কিন্তু মনের মনি কোঠায় আজও উজ্জ্বল।”

জানার নেশা- 

আমাদের সময় জয়েন্ট এন্ট্রান্সে  ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পাওয়া একটা সাফল্যের মাপকাঠি ছিল।আমিও ভীষণ ভাবে পড়াশুনা করেছিলাম এই পরীক্ষার জন্যে।কিন্তু নিজেকে প্রমাণ করতে পারিনি। একটা অদ্ভুত যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম সেসময়।আমার অনেক চেনা বন্ধুকেই দেখতাম হতাশা থেকে মুক্তি পাবার জন্য সিগারেট, মদ আরো না জানি কত রকম নেশা করতো। এসব আমাকে হাতছানি দেয়নি তা নয়; তবে আমি সে সব পথে পা বাড়ায়নি । এক্ষেত্রে হয়ত পুরো কৃতিত্বটাই আমি আমার স্কুলের। মনে আছে, লাইব্রেরী এবং নেট ঘেঁটে একটা সময় সারা বিশ্ব জুড়ে ভাইন ইয়ার্ডের ওপর মোটামুটি এক গবেষণা করে ফেলেছিলাম এবং নানান ধরনের ওয়াইন চেখে দেখার সাধ হয়েছিল। আজ এতবছর পরে, কর্ম ক্ষেত্রে কোনও ক্লায়েন্ট মিটিং এ যখন ওয়াইন নিয়ে আলোচনা হয় তখন ঐ গবেষণা বেশ কাজে লাগে। আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বলতে পারেন সবকিছুর থেকেই  কিছু শেখার বা জানার একটা নেশা আমার আছে। কিন্তু ওই তরলের ইতিহাস জানতে গিয়ে আমি কখনো তার মধ্যে একেবারে তলিয়ে যায়নি। কিম্বা ইঞ্চি শ্বেতশুভ্র সিগারেটের মধ্যে ভালো তামাকের খোঁজ করতে গিয়ে নিজেকে ভস্মীভূত করে ফেলিনি।

এমনি ভাবেই বিভিন্ন বৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়ে দিনগুলো বেশ ভালই চলছিল। প্রফেসরদের নজরে পড়েছিলাম আমার সুন্দর ব্যবহার, ভালো রেজাল্ট, পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ আর ছিমছাম চেহারার জন্য ।আস্তে আস্তে ফাইনাল ইয়ারে এসে উপলব্ধি করছিলাম পদার্থবিদ্যা,অঙ্ক,রসায়নের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের নানান বিষয় নিয়ে আমার মধ্যে কৌতূহল তৈরি হচ্ছে।এবং পরবর্তী কালে সেই কারণে আমি বেনারসের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছিলাম। সেসব অভিজ্ঞতাও পরবর্তীকালে আপনাদের সাথে ভাগ করে নেব।

‘মিশন অ্যান্ড ভীষণ’

কিন্তু তার আগে বলি, এই যে সুদূর আসানসোল থেকে পুরুলিয়া তারপর কলকাতা মহানগরীর এই পথটা যত সহজে শব্দ দিয়ে বেঁধেছি ঠিক ততটা মসৃণ ছিলনা। তবে এটা বুঝেছি কঠিন অধ্যবসায় এবং গভীর মনোযোগ থাকলে কোন স্বপ্ন পূরণই অসম্ভব নয়। তাই মিশন থেকে শিখেছিলাম ‘চরৈবেতি’ আর সেন্ট জেভিয়ার শেখালো“Nihil Ultra” (means nothing beyond).

জেভিয়ার্সে  থাকাকালীন আমার স্কুল জীবনকে মাঝেমাঝে ভীষণ মিস করতাম। তবে একটু অদলবদল করলে কিন্তু দুই প্রতিষ্ঠানের মূলমন্ত্র ছিল একই। কারণ সেন্ট জেভিয়ার্সের vision ছিল-

To promote a society based on love,freedom,liberty,justice,equality and fraternity.– যার ভিত্তি প্রস্তর আমার মধ্যে স্থাপনা করে দিয়েছিল আমার স্কুল অনেক আগেই।

মিলন মেলা;

St.Xavier এর Xavotsob  এর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিম্বা পদার্থবিদ্যা বিভাগ থেকে নানান বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠিত দুদিনের ‘Spectrum’;   পদার্থবিদ্যা বিভাগের নিজস্ব পত্রিকা ‘Horizon  এর মধ্য দিয়ে প্রকৃত অর্থে রামকৃষ্ণ মিশনের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা স্কুল ম্যাগাজিনের একটু আধুনিক রূপই দেখতে পেতাম আমি।সেন্ট জেভিয়ারই এমন একটি ইংরেজি মাধ্যম কলেজ যেখানে বাংলা বিভাগের জন্য Xavullas and Vividha  হিন্দি বিভাগের জন্য আলাদা করে অনুষ্ঠিত হতো। আর এই ব্যবস্থা আমার অদ্ভুত ভালো লাগতো।সব মিলিয়ে মনে হত কোথাও একটা  ‘প্রাচ্য পাশ্চাত্যের ছোঁয়া’ মেলবন্ধন খুঁজে পাচ্ছি নিজের মধ্যে। তাই মনে হয় টেমসের তীরে লন্ডন কে অতটাই আপন করে নিতে পারি যতটা ভাগীরথী বক্ষে তিলোত্তমা কোলকাতা কে পেরেছিলাম।আজ এই পর্যন্তই।

ভাল থাকবেন।