রাত্রি তখন বারোটা। লন্ডনের হিমশীতল আবহাওয়ায় সারাদিনের ক্লান্তির পর তখন আমরা ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ পাড়ি দিয়েছি। হঠাৎ ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠলো। ভীষণ উৎকণ্ঠায় ফোনটা ধরে বললাম ‘হ্যালো’। ফোনের ওপার থেকে ভেসে এলো বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের “আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে...”
মায়ের ফোন। ভারতীয় সময় ভোর চারটেয় মা রেডিওতে মহালয়া শুনতে গিয়ে আমাদের অসম্ভব মিস করছে বুঝতে পারলাম। চোখ বন্ধ করে যেন দেখতে পেলাম ভিজে এলো চুলে, লাল পেড়ে শাড়িতে ,তুলসি তলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে মা আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন।নাকে লাগল ধুনোর–গন্ধ; সমস্ত ঘরে বেশ যেন একটা প্রাক পূজার আমেজ।কেমন একটা ঘোর লেগে গেল। চমক ভাঙলো মায়ের কথায় “বাবু তোদের সবাইকে শুভ মহালয়া জানালাম।খুব ভালো থাকিস”।লাইনটা কেটে গেল। কিন্তু একটা নেশার ঘোর লেগে রইলো যেন আমার পঞ্চেন্দ্রিয় জুড়ে।
দেবী পক্ষের সুচনাঃ
পিতৃপক্ষের শেষে দেবীপক্ষের শুরু আর একইসঙ্গে শুরু শারদীয় দুর্গোৎসবের পুণ্য–লগ্নেরও। হিন্দুশাস্ত্র মতে দেবী দুর্গার এই আবাহনই “মহালয়া” হিসেবে পরিচিত। এদিন গঙ্গাতীরে ভক্তরা তাদের পরলোকগত আত্মীয়–স্বজন এবং পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তি কামনা করেন। আর সারা বছর ঘুরে এই দিনেই দেবী দুর্গা সপরিবারে মর্তলোকে পা রাখেন অর্থাৎ বাপের বাড়ি আসেন। আর এই দিন ভোর বেলা থেকেই স্থায়ী অস্থায়ী সমস্ত চণ্ডীমণ্ডপে উচ্চারিত হতে থাকে
“ ইয়া দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা / নমস্তসমই নমস্তসমই নমস্তসমই নমো নম:”
মাটির টানে:
বিগত কয়েক বছর ধরে দুর্গাপুজোয় নিয়মিত বাড়ি যাওয়া আর হয় না। গঙ্গা ছেড়ে টেমসের তীরে বসেই তাই মাতৃ আরাধনায় আমাদের মত প্রবাসী বাঙালিরা মেতে ওঠেন। আমাদের এখানেও আশেপাশের কিছু বাড়ির বাগানের কাশফুল জানান দিচ্ছে মায়ের আগমনী বার্তার। খুব মনে পড়ছে মামা বাড়ির পূজোর আনন্দ, দিদিমা–মাসিমাদের আদর আবদার,আমাদের তুত ভাই বোনদের লাগামছাড়া দুষ্টুমি… আরো কত কি। তবে আজ সব থেকে বেশি যে মানুষটির কথা মনে পড়ছে তিনি আর কেউ নন আমার স্বর্গীয় দাদু ( মায়ের বাবা) শ্রী দীনবন্ধু মণ্ডল।
গ্রামের নামটি হিজল গড়া:
পশ্চিমবাংলার বর্ধমান জেলার জামুড়িয়া থানার অন্তর্গত হিজল গড়া নামের ছোট্ট একটি গ্রাম। আমার দাদু এই গ্রামেরই একজন গণ্যমান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। খুব ছেলেবেলা থেকেই বছরের এই সময়টার জন্য মুখিয়ে থাকতাম আমরা । আমার জীবনের বেশিরভাগটাই যেহেতু কেটেছে হোস্টেলে; তাই পুজোর ছুটির সময় মনে হত কবে মামার বাড়ি যাবো। মুলতঃ মামার বাড়ি যাওয়ার ‘রাস্তা থেকে পুরো পুজো’টাই আমার কাছে ছিল এক রোমাঞ্চকর সফর।
![](https://tarak.gorai.info/wp-content/uploads/2018/10/IMG_6284-169x300.jpg)
My Son with my Cousin
![](https://tarak.gorai.info/wp-content/uploads/2018/10/IMG_6283-169x300.jpg)
Aryan, trying his chores
আমাদের আসানসোলের বাড়ি থেকে জামুড়িয়ার বিজয়নগর বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে লাগে ঘণ্টা খানেক। তারপর কিছুটা হেঁটে একটা জোড় পেরিয়ে আরো 5-7 কিলোমিটার আঁকাবাঁকা মেঠো রাস্তা; তারপর কিছু কাঁচা পাকা ঘর পেরিয়ে আমাদের বিশাল ‘মণ্ডল বাড়ি’। মনে আছে ৩০ বছর আগের স্মৃতি; আমাদের যাওয়ার দিন দাদু সেই জোড়ের মুখে গাড়োয়ানকে দিয়ে গরুর গাড়ি পাঠিয়ে দিতেন আমাদের আনতে। গরুর গাড়ির ছাউনির ভেতর খড়ের গাদার ওপর বিছানো কম্বলে শুয়ে, দুলতে দুলতে ‘এসেছে শরৎ হিমের পরশ’ কিংবা রবি ঠাকুরের ‘শারদ প্রাতে’ গুনগুন করতে করতে সাদা পেঁজা তুলোর মত মেঘের মধ্যে নানান আকৃতি বিকৃতি কল্পনা করতে করতে পৌঁছে যেতাম মামার বাড়ি।(প্রসঙ্গত বলি, ছোটবেলার আমার ড্রয়িং খাতায় আঁকা –গ্রামের লাল মেঠো পথে গরুর গাড়ির দৃশ্য অথবা কলসি কাঁখে আটপৌরে শাড়ী পড়া গ্রাম্য মেয়েদের ছবির আইডিয়া গুলো এই গ্রামেই দেখা ঘটনার জলরঙ প্রকাশ মাত্র।)
দেখেছি তার ভ্রমর কালো চোখ/বেদন হাসি; নেই অভিযোগ:
একে একে পরিবারের সব সদস্যরা জুটতাম একই ছাদের নিচে। মূলত এদিন মেয়েরা বাপের বাড়ি যায়– খারাপ লাগে আমার স্ত্রীর কথা ভেবে। প্রতি বছর বাপের বাড়ির পুজো দেখতে, আমাদের দুজনের অফিস আর ছেলের স্কুলের ছুটি ম্যানেজ করে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনা ।বুঝি, আমার মতো ও হয়ত একই ভাবে মিস করে তার আত্মীয় স্বজন,বন্ধু পরিজনকে।যদিও ওর “কালো ভ্রমর চোখে” কোনদিন কোনও অভিযোগ দেখলাম না। তবুও মনে হয় কোথাও যেন কিছু একটা বাকি থেকে গেল নাতো? যদিও লন্ডনেও আমরা সপরিবারে খুব হৈ হৈ করে পুজো কাটাই।
ষোলোআনা বাঙ্গালিয়ানাঃ
ফিরে আসি মামার বাড়ির পূজার কথায়।মামার বাড়িটা পুরানো দিনের একান্নবর্তী বনেদি বাড়ির আদলেই তৈরি।মস্ত দালান,অতিথিদের জন্যে বিরাট বৈঠকখানা,ঝুল বারান্দা,বাগান বাড়ি।তার একধারে আবার ঢেঁকিশাল, কুয়ো, গোয়াল ঘর।বাড়ির পেছনের দিকটায় খামার ঘর, ধানের গলুই আরও একটু এগিয়ে ‘শান বাঁধান’ পুকুর– যেখানে মাছ ও চাষ হয়।
আমাদের সকলের দুর্গাপূজা পূজার শুরু হয়ে যেত সেদিনই– যেদিন খুঁটি পুজো হতো। প্যান্ড্যাল এর বাঁশে ঝুলে ভাইবোনেরা কত খেলেছি পড়েছি হাত পা কাটিয়ে বকুনি খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।আর প্রচুর ঝগড়া করেছি “পুজো বার্ষিকী’টা কে আগে পড়বে।সুদূর লন্ডনে বসে এই ‘পুজো আসছে,পুজো আসছে–চার্ম টা অনুভব সে ভাবে আর হয় না।নতুন কাপড়ের গন্ধ, পাট ভাঙ্গা ধুতির সাবেকিয়ানা– এগুলো বড্ড মিস করি।কারণ এখানে ‘পুজো স্পেশাল শপিং’ করার সেই হুজুগটা নেই।
প্রাক পূজা প্রস্তুতি:
মামার বাড়ির পুজোর দিনগুলির মাহাত্যই ছিল আলাদা।সেই ভোর বেলা ঢাকিদের ঢাকের আওয়াজে,আধো অন্ধকারে, ঘুম জড়ানো চোখে কুয়োর ঠাণ্ডাগরম জলে স্নান করে, পাজামা পাঞ্জাবি পরে শুরু হয়ে যেত আমাদের পুজো।প্রতিবার পুজোই আমাদের বাড়িটা ,দুর্গা–মন্দির গেট এগুলো রঙ করা হতো।আমিও প্রচুর উৎসাহে রঙ করতে জুটে যেতাম; তবে বলায় বাহুল্য এশিয়ান পেন্টস গেটে কম গায়ে বেশী মেখে বসে থাকতাম।ফলত সেই দিনটাতে আমার সমস্ত শরীর ‘পেন্ট আর কেরোসিনের’ গন্ধে ম’ম করত– কারণ মামার কাছে আমার গায়ের রঙ তোলার জন্যে কেরোসিন ছাড়া আর অন্য কোনও অপশন থাকত না।
পুজো যত এগিয়ে আসত বাড়ির উঠোনে যাবার “পাবন্ধি’ তত লেগে যেত।কারণ পুজোর জন্যে ‘ভিয়ান’ বসত সেখানে।বিশাল আকারের মাটির উনুনে বিশাল বিশাল কড়াইয়ে চলত নানান ধরনের মিষ্টি বানান –টানা/চনা লাড্ডু , বোঁদের লাড্ডু , নারকেল নাড়ু, আড়সা (চালের গুঁড়ি আর গুড় দিয়ে তৈরি ভাজা মিষ্টি) আরও কতকি।পুকুর ঘাটে তেঁতুল দিয়ে ঘসে মেজে চকচকে করে রাখা হতো পুজোর কাঁসার বাসন গুলি।তার ওপর শরতের রোদপড়ে সে গুলো মনে হতো যেন সোনার।আঁকতে ভালবাসতাম বলে এ সময় আলপনা দেওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার।তাই সারা বাড়ি উঠোন মন্দিরময় নানান রকম আল্পনায় ভরিয়ে দিতাম মনের আনন্দে।
ইভেন্ট ম্যানেজার – দিদিমা
অন্যদিকে এত বড় মহাযজ্ঞের সুপরিকল্পিত এবং সুনির্দিষ্ট এ সমস্ত আয়োজন বড়ই নিখুঁতভাবে দশভুজার মতোই সামলাতেন আমার দিদা । মা দুর্গার সমস্ত উপাচার সহ ঘরে উপস্থিত সকলের থাকা –খাওয়া– শোয়া থেকে শুরু করে কাকে কাকে আমন্ত্রণ করতে হবে, পুরোহিত –রান্নার ঠাকুর, নাপিত –জেলেদের কখন ডাকতে হবে; কাকে কি উপহার দিতে হবে– বলতে গেলে সবকিছুই তিনিই সামলাতেন। পুজোর সময় চাল –ডাল– মিষ্টি– কাপড় এমনকি মাছ ও উপহার হিসেবে গ্রামের নানান বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা ও তিনি আজও করে চলেছেন।
মায়ের পুজো / স্বপ্নাদিষ্ট ঃ
এইবার 51 বছরে পা দিলো আমাদের এই মণ্ডল বাড়ির পুজো। বহু দূর দূরান্ত থেকে লোকজন দেখতে আসে এই পুজো । এর অন্যতম কারণ আমাদের মাতৃ বিগ্রহটি ;এটি আসলে ‘একটি উইয়ের ঢিবি’। আগে উচ্চতায় সাড়ে 5 ইঞ্চি ছিল; কালের নিয়মে তা অনেকটাই ছোট হয়ে গেছে। ঢিবির আকার দেখে সহজেই বোঝা যায়– মা দুর্গা তার দুই পাশে লক্ষ্মী সরস্বতী এবং কার্তিক গণেশ কে নিয়ে সপরিবারে বিরাজমান।
আমাদের পূর্বপুরুষেরা স্বপ্নাদিষ্ট হয়েছিলেন এই উইঢিবিকে মাতৃ রূপে পূজা করতে। সকলের বিশ্বাস, খুবই জাগ্রাত মা-দুর্গা। এছাড়া আরো একটি আশ্চর্যের বিষয় হলো – এর ইঞ্চি খানেক দূরে স্বাভাবিকভাবেই একটি পূর্ণ শিবলিঙ্গের ঢিবিও রয়েছে। যার পাদদেশে রয়েছে তিনটি ছিদ্র। আমার দিদিমা অনেকবার দেখেছেন সেই ছিদ্র থেকে বেরিয়ে নাগরাজেরা ঐ শিবলিঙ্গ কে জড়িয়ে রয়েছে। পরবর্তীকালে ঐ ঢিবিগুলিকে মাঝখানে রেখেই আমাদের দুর্গা মন্দির গড়ে উঠেছে।
পুজোর শুরুর সাথে সাথেই দাদু আমাদের বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন কাজের ভার দিতেন। যেমন কে কে কাঁসরঘণ্টা শঙ্খ বাজাবে; কে 108 টা পদ্ম ফোটাবে, কে 108 টা প্রদীপ জ্বালাবে, আলপনা দেবে বা নৈবেদ্য সাজাবে ইত্যাদি।একটি ছোট্ট ঘণ্টা বাজানোর দায়িত্ব দিয়ে সর্বপ্রথম আমি পূজার কাজে অংশগ্রহণ করি ছেলেবেলায়। তারপর পদোন্নতি হয়ে ধুনো জ্বালানোর কাজ পেলাম। আমি অতি উৎসাহে এবং একবিন্দুও ফাঁকি না দিয়ে এমন ‘ ধোঁয়াদার পারফরম্যান্স’ দিতাম যে সবাই বলতো ‘ওরে এবার থাম; চোখের জল এই বুঝি বান ডাকবে’। এখনো মামার বাড়িতে ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে’। শুধু স্থান কাল এক রেখে পাত্র গুলিই বদলে গেছে। আজ সে ঘণ্টা বা ধুনুচি আমাদের ছেলে মেয়েদের দায়িত্বে।
শার্লক হোমসের ভূমিকায় আমি:
পুজোর সময় আমার আরও একটি বিশেষ কাজ ছিল । জেলেরা যাতে মাছ চুরি না করতে পারে তাই তাদের পাহারা দেওয়া। কাজটা শুরুতে মন দিয়ে করলেও পরের দিকে জেলেদের জালে ওঠা ছোট ছোট জ্যান্ত মাছ গুলোকে আবার জলে ছেড়ে তাদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলতাম। কারণ আমার মনে হতো ওরা অনেক ছোট এখনও ওদের গরম তেলের কড়াইয়ে যাওয়ার সময় হয় নি। যখন আরেকটু বড় হলাম তখন হাতে এল ক্যামেরা। আমার ফটোগ্রাফির শখটা বোধহয় তখন থেকেই শুরু।
ভালো মন্দ খেতে ছোটবেলা থেকেই বেশ ভালোবাসি।তাতে, পুজোর সময় লম্বা বারান্দায় শালপাতার পাতায় ‘বোঁদে –মুড়ি ’ জলখাবার ই বলুন কিংবা অষ্টমীতে লুচি – নারকেল দিয়ে ছোলার ডাল, কুমড়োর ছক্কা কিংবা নবমী –দশমী র আমিষ ভোজনই বলুন ,সবই যেন লাগত অমৃত। আর রান্না হত ঘরের গরুর দুধের তৈরি বিশুদ্ধ গাওয়া ঘি–এ।
মায়াবী নিশি:
মামার বাড়ির পুজোতে একটা অদ্ভুত–আবেশে বিভোর থাকতাম যেন সর্বদা। মাটির সোঁদা গন্ধ, সবুজ গাছগাছালি ঝোপঝাড়ের বনজ গন্ধ, ঝিঝি পোকার ডাক, সদলবলে পুকুরে স্নান করতে যাওয়া, বাজি পোড়ানো, গাছে চড়া ; সুট বুট জুতো জামা ছেড়ে কাদা মাটি মেখে দোল আনতে যাওয়া, এ সবেতেই কেমন যেন একটা রোমাঞ্চ লাগতো। চোখ বন্ধ করলে আজও দেখতে পাই– জলে টইটম্বুর নদী পুকুর, গ্রামের কাঁচা পাকা ঘর, সাপের মতো এঁকে–বেঁকে যাওয়া আল–জমি, শাপলা শালুক শিউলির মাঝে নীল কাজলের কাজল লতার মতো অপরাজিতার শোভা, মৃদুমন্দ হাওয়ায় কাঁচা মিঠে রোদ আর লাল পেড়ে সাদা শাড়ি – বড় লাল টিপে, শাদা লাল শাঁখা পলায় দিদিমা মাসীমা দের সেই অপরূপ মাতৃরূপ।
হ্যাজাকের আলোয়/অন্ধকার পুরোয়
আমাদের গ্রামে শুরুর দিকে ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না তাই রাতের অন্ধকারে জ্বালানো হত বড় বড় ‘হ্যাজাক’(পাম্প করে জ্বালানো এক রকমের হ্যারিকেনের মতো বড়ো বাতি)। মামাকে দেখতাম কত কষ্ট করে কয়েক ডজন হ্যাজাক জ্বালিয়ে ফেলতেন বিনা বাক্য ব্যয়ে। কিন্তু জ্বলে যাবার পর এমনই তার আলো যে অন্ধকারেও দিন মনে হতো। আমার ছোট দাদু অর্থাৎ মায়ের মামাকে দেখতাম সমস্ত রাত জেগে পুজোর ‘অখণ্ড জ্যোতি’ পাহারা দিতে আর তার সাথে থাকতেন গ্রামের অন্যান্য বয়স জ্যেষ্ঠরাও; চলত জমিয়ে তাসের আড্ডা আর সাথে মাটির ভাঁড়ে …চা।
বিজয়ার বিদায় বাঁশি:
এমনি করেই বারি আনা ,সন্ধি পূজা, ঠাকুরের ‘রচনা’ তৈরি থেকে কখন যে বিজয়া দশমী উপস্থিত হতো বুঝতেই পারতাম না । আবার সেই গতানুগতিক জীবনে ফিরে যেতে হবে ভেবে মনটা একটু খারাপ হয়ে যেত । এদিন ‘দুধ কলা সন্দেশ আর অল্প একটু সিদ্ধি পাতা’ মিশিয়ে এক ধরনের ককটেল বানানো হতো। আজও দেশ–বিদেশের তাবড় তাবড় হোটেলে বেশ কয়েকবার ককটেল খেয়েছি কিন্তু ওরকম স্বাদ বুঝি আর কিছুতেই নেই। বিজয়া দশমীতে আমরা ছোটরা বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতাম আর আর সমবয়সীরা করতেন কোলাকুলি। আর সবশেষে হত ঘরের তৈরি মিষ্টিতে মিষ্টিমুখ।
এখনও অধরা/ কলকাতার পূজোরাঃ
আমি যখন কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ি (বয়েস উনিশ কি কুড়ি) তখন বহুবার ভেবেছি কলকাতায় থেকে কলকাতার পুজোর উল্লাসে মেতে উঠবো বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে । কিন্তু পুজোর ছুটি পড়া মাত্রই এক অদৃশ্য বশীকরণ মন্ত্র বলে সোজা পাড়ি দিতাম মামা বাড়ির উদ্দেশ্যে । আজও সেভাবে কলকাতার পুজো চাক্ষুষ দেখা হইনি। তবে ভবিষ্যতে আমার স্বপ্ন সস্ত্রীক পায়ে হেঁটে কলকাতার সমস্ত অলি–গলির পুজো পরিদর্শন করব আর চুটিয়ে ‘ফুচকা –ঘুগনি –চাট’ খাব।
প্রবাসে পূজা:
বাংলার বাইরে এসে বাড়ির পুজো কে সত্যি খুব মিস করি আমরা । তবে আমি যখন লন্ডনের Harrow তে ছিলাম বছর ৫, তখন সেখানের ‘পঞ্চমুখী দুর্গা পুজোর, কথা না বললেই নয় । প্রবাসে এসে এত সুন্দর নিষ্ঠাভরে মায়ের পূজা উপাচার দেখে সত্যিই মন ভরে গিয়েছিল। ছোট বেলার মতো পুরোহিত মশাই এর পাশে ধুতি পাঞ্জাবি পরে পুরো পুজোটা দারুণ উপভোগ করতাম।ছোট থেকেই পূজা–পার্বণ, মন্ত্র–শঙ্খ–উলুধ্বনি আমার খুব ভালো লাগে।
তাই এখানে যখন প্রতিবছর শঙ্খ ধ্বনি প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম হই সবাই খুব অবাক হয় কিন্তু আমি বলি–এটি আমার অভ্যাসের ফল নয় এটি আমার রক্তে ।হেরও পঞ্চমুখী পুজো ছাড়াও আমার বাল্যবন্ধু ডঃ শ্রীজিত ব্যানার্জীর উৎসাহে এবং অনুপ্রেরণায় প্রতিবছর আমি স্ত্রী–পুত্র সহ কোমর বেঁধে নেমে পড়ি ‘নরউইচের বঙ্গ সমিতির’ পুজোর নানান কাজে ।
প্রযত্নে ‘প্রয়াস:’
বর্তমানে লন্ডনের বাকিংহামশায়ারে আমার বাস। বিগত দুই বছর ধরে মাতৃ আরাধনা হেতু আমরা শুরু করেছি ‘প্রয়াস’। আমাদের নবীনতম এই পূজা কমিটির দুর্গা পূজা ছাড়াও আরও একটি উদ্দেশ্য হল আমাদের উত্তরসূরিদের বাঙালি সভ্যতা সংস্কৃতির এই দুর্লভ অভিজ্ঞতায় শামিল করা ।প্রবাসেও আমরা অফিসের কর্মব্যস্ততার মধ্যেও নিয়ম করে চারদিন পুজো পালন করি ।দেখতে দেখতে ভোগ –প্রসাদ– নাচ– গান– আনন্দে চারদিন নিমেষে কেটে যায়।
মায়ের–পূজার গন্ধে/মন মাতে আনন্দে–
আমার মা–বাবা বা আমার শ্বশুর–শাশুড়ির একটা সময় ধারনা ছিল, প্রবাসে আমরা বুঝি মায়ের পূজার সৌভাগ্য–লাভ থেকে পুরপুরি বঞ্চিত হই।কিন্তু আমি যখন তাঁদের লন্ডনের পূজায় সরিক করার সুযোগ পেলাম এক বাক্যে তাঁরা স্বীকার করেছিলেন ‘যুগে যুগে স্থানে স্থানে মায়ের কৃপা অপার’।সেদিন মনের গোপনে থাকা আরেকটি স্বপ্ন যেন সত্যি হয়েছিল।
তাই স্বদেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকি না কেন দুর্গাপূজায় বন্ধু–বান্ধবদের নিয়ে আমি খুব আনন্দেই কাটাই। মামার বাড়ির পুজোতে দিদাকে ফ্যামিলি ম্যানেজমেন্ট এবং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর যে ভূমিকায় দেখতাম, বলতে দ্বিধা নেই আমার স্ত্রীর মধ্যেও তার যেন কিছুটা ঝলক এখানে আমি দেখতে পাই । আর বেশী স্বপ্নগুলো সত্যি মনে হয় , যখন দেখি পশ্চিমী আদব–কায়দায় বড় হওয়া আমার ছেলে ধুতি পাঞ্জাবি পরে সবার সাথে গলা মিলিয়ে বলে ঃ
‘দেহি সৌভাগ্যমারগ্যং , দেহি দেবী পরমসুখম।
রূপং দেহি, জয়ং দেহি ,যশো দেহি দ্বিষো যহি’।।
পরিশেষে বলি, আর মাত্র কিছুদিন পরেই পুজো।খুব ভাল থাকুন;আনন্দে থাকুন।
আপনাদের
তারক নাথ গড়াই ( TNG )
London,UK
Media Enquiry: +44 7921699563
![](https://tarak.gorai.info/wp-content/uploads/2018/10/IMG_6276-300x225.jpg)
![]() |
My Son with my Cousin |
![]() |
Aryan, trying his chores |
আমাদের আসানসোলের বাড়ি থেকে জামুড়িয়ার বিজয়নগর বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে লাগে ঘণ্টা খানেক। তারপর কিছুটা হেঁটে একটা জোড় পেরিয়ে আরো 5-7 কিলোমিটার আঁকাবাঁকা মেঠো রাস্তা; তারপর কিছু কাঁচা পাকা ঘর পেরিয়ে আমাদের বিশাল ‘মণ্ডল বাড়ি’। মনে আছে ৩০ বছর আগের স্মৃতি; আমাদের যাওয়ার দিন দাদু সেই জোড়ের মুখে গাড়োয়ানকে দিয়ে গরুর গাড়ি পাঠিয়ে দিতেন আমাদের আনতে। গরুর গাড়ির ছাউনির ভেতর খড়ের গাদার ওপর বিছানো কম্বলে শুয়ে, দুলতে দুলতে ‘এসেছে শরৎ হিমের পরশ’ কিংবা রবি ঠাকুরের ‘শারদ প্রাতে’ গুনগুন করতে করতে সাদা পেঁজা তুলোর মত মেঘের মধ্যে নানান আকৃতি বিকৃতি কল্পনা করতে করতে পৌঁছে যেতাম মামার বাড়ি।(প্রসঙ্গত বলি, ছোটবেলার আমার ড্রয়িং খাতায় আঁকা –গ্রামের লাল মেঠো পথে গরুর গাড়ির দৃশ্য অথবা কলসি কাঁখে আটপৌরে শাড়ী পড়া গ্রাম্য মেয়েদের ছবির আইডিয়া গুলো এই গ্রামেই দেখা ঘটনার জলরঙ প্রকাশ মাত্র।)
তারক নাথ গড়াই ( TNG )
London,UK
Media Enquiry: +44 7921699563
![]() |
My family and Parents in 2016, London |
মামাবাড়ি-র কিছু ছবি।